ঈদুল আজহার জন্য সঠিক পশু নির্বাচন জরুরি। এর ওপর নির্ভর করে আপনার কোরবানি সঠিক হচ্ছে কিনা। সেই সাথে তো পরিবার প্রতিবেশী, গরিব আত্মীয়স্বজনের হক পূরণের জন্য যথেষ্ট গোশত পাওয়ার নিশ্চয়তাও থাকতে হয়। কারণ কোরবানি তো নিজে খাওয়ার জন্য নয়। আল্লাহর জন্য উৎসর্গ আর গরিব দুঃখীদের বিলিয়ে দেওয়ার নামই তো কোরবানি। এখানে কোরবানির পশু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে সেগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. বয়স
কোরবানির পশুর জন্য বয়স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়তে নির্দিষ্ট বয়সের পশু দ্বারা কোরবানি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গরু ও মহিষ: এই প্রাণীগুলোর জন্য কমপক্ষে ২ বছর বয়স হতে হবে। এর কম হলে কোরবানি জায়েজ হবে না।
ছাগল ও ভেড়া/দুম্বা: এগুলোর জন্য কমপক্ষে ১ বছর বয়স হতে হবে। তবে, ভেড়া বা দুম্বা যদি ছয় মাস বয়সী হয় এবং দেখতে এক বছর বয়সী ভেড়া বা দুম্বার মতো হৃষ্টপুষ্ট ও বড় দেখায়, তাহলে তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। কিন্তু ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই কোরবানি জায়েজ হবে না, কারণ ছাগলের শারীরিক বৃদ্ধি তুলনামূলক ধীর।
উট: উটের জন্য কমপক্ষে ৫ বছর বয়স হতে হবে।
দাঁত দেখে বয়স যাচাই
পশুর বয়স নির্ণয়ের একটি প্রচলিত এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো তার দাঁত পরীক্ষা করা। এটিকে "দাঁত কাটা" বা "দাতাল" বলা হয়।
১ বছর বয়সে: গরুর সামনের পাটির মাঝের দুটি অস্থায়ী বা দুধ দাঁত পড়ে যায় এবং সেখানে দুটি নতুন, বড় ও স্থায়ী দাঁত ওঠে।
২ বছর বয়সে: সামনের পাটির মাঝের দুটি স্থায়ী দাঁত পুরোপুরি বড় হয়ে যায় এবং এর দুই পাশে আরও একটি করে নতুন স্থায়ী দাঁত ওঠে। এতে মোট ৪টি স্থায়ী দাঁত দেখা যায়। সাধারণত, এই ৪টি স্থায়ী দাঁত উঠলেই গরুকে কোরবানির উপযুক্ত ধরা হয়। এটি নির্দেশ করে যে গরু ২ বছর বা তার বেশি বয়সী।
৩ বছর বয়সে: সামনের পাটিতে মোট ৬টি স্থায়ী দাঁত দেখা যায়।
৪-৫ বছর বয়সে: সামনের পাটির সবগুলো (৮টি) অস্থায়ী দাঁত পড়ে গিয়ে ৮টি স্থায়ী দাঁত উঠে যায়। এটি পূর্ণ বয়স্ক গরুর চিহ্ন।
গুরুত্বপূর্ণ নোট: যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে গরুর বয়স ২ বছর পূর্ণ হয়েছে (যেমন খামারের রেকর্ড বা জন্ম সনদ দেখে), কিন্তু দাঁত ওঠেনি বা দাঁতের সংখ্যা কম দেখাচ্ছে, তাহলেও সেই গরু দিয়ে কোরবানি সহীহ হবে। দাঁত দেখা শুধু একটি নির্দেশক, মূল বিষয় হলো পশুর প্রকৃত বয়স।
২. শারীরিক সুস্থতা
কোরবানির পশু অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে সুস্থ ও ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। অসুস্থ বা ত্রুটিযুক্ত পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ নয়।
চোখ ও চেহারা: পশুর চোখ উজ্জ্বল, পরিষ্কার এবং সজীব দেখাবে। চোখের আশেপাশে কোনো ময়লা, পুঁজ বা অস্বাভাবিক লালচে ভাব থাকবে না। একচোখা বা যে পশুর দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তা কোরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।
চলাফেরা: পশু স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করবে, দৌড়াতে বা হাঁটতে কোনো অসুবিধা হবে না। খোঁড়াবে না বা এক পা টেনে হাঁটবে না। যে পশুর একটি পাও এমন খোঁড়া যে, সে ওই পায়ের উপর ভর দিয়ে চলতে পারে না, তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ নেই।
শরীর: পশুর শরীরে কোথাও ফোলা দাগ, ঘা, চুলকানি, ক্ষত বা মাংসপেশীতে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকবে না। চামড়া টানটান ও পরিষ্কার থাকবে। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর পেট অস্বাভাবিকভাবে ফোলা দেখায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট বা হাঁপানির মতো শব্দ থাকতে পারে। এমন গরুর গায়ে চাপ দিলে মাংস দেবে যাবে এবং সহজে আগের অবস্থায় ফিরতে চাইবে না। সুস্থ গরুর শরীর সুগঠিত, টানটান ও মজবুত থাকবে।
নাক: সুস্থ পশুর নাকের উপরের অংশ সাধারণত ভেজা ভেজা থাকবে এবং বিন্দু বিন্দু ঘাম বা শ্লেষ্মা দেখা যাবে। অসুস্থ পশুর নাক শুষ্ক থাকে, যা জ্বর বা ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ হতে পারে।
খাওয়া-দাওয়া: সুস্থ পশু খাবার দেখলে আগ্রহ নিয়ে খাবে এবং নিয়মিত জাবর কাটবে। অসুস্থ পশু খাবার খেতে অনীহা দেখাবে, জাবর কাটবে না বা খুব কম কাটবে।
তাপমাত্রা: পশুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে। অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ বা নিম্ন তাপমাত্রা অসুস্থতার লক্ষণ।
লেজ ও কান: সুস্থ পশু ঘনঘন লেজ নাড়াবে এবং কান দিয়ে মাছি তাড়াবে। এটি পশুর সজীবতার লক্ষণ। কান কাটা বা ছেঁড়া পশু কোরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।
অন্যান্য ত্রুটি
শিং: যে পশুর শিং গোড়া থেকে ভেঙে গেছে, তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ নেই। তবে অল্প ভাঙা বা শিংহীন (জন্মগত) পশুর ক্ষেত্রে কোরবানি জায়েজ আছে।
লেজ: লেজের এক-তৃতীয়াংশ বা তার বেশি কাটা থাকলে সেই পশু কোরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।
দাঁত: যে পশুর অধিকাংশ দাঁত পড়ে গেছে, তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ নেই।
অত্যন্ত দুর্বল বা রোগাক্রান্ত: যে পশু এতটাই দুর্বল যে সে নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারে না বা হাঁটতে পারে না, অথবা যে পশু কোনো গুরুতর রোগে আক্রান্ত, তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ নেই।
অন্ধ বা মারাত্মক দৃষ্টিশক্তিহীন: যে পশু সম্পূর্ণরূপে অন্ধ বা এমনভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে যে সে পথ চলতে পারে না, তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ নেই।
গর্ভবতী কিনা: গাভী কোরবানি দেওয়া জায়েজ। তবে, কেনার সময় নিশ্চিত হতে হবে যে গাভীটি গর্ভবতী নয়। গর্ভবতী গাভী কোরবানি দেওয়া মাকরুহ বা ক্ষেত্রবিশেষে জায়েজ নয়, কারণ এতে সন্তানের ক্ষতি হয়।
৩. আচরণ
পশুর আচরণ দেখেও তার সুস্থতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
* সুস্থ পশু চঞ্চল এবং সজাগ থাকবে। আশেপাশে শব্দ হলে বা কোনো মানুষ কাছে গেলে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
* অসুস্থ বা ইনজেকশন দেওয়া (যেমন: মোটাতাজাকরণের জন্য স্টেরয়েড) গরু ঝিমিয়ে থাকবে, অলস দেখাবে এবং তাদের নড়াচড়া কম হবে। স্টেরয়েড দেওয়া গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত এবং হাঁপানির মতো হতে পারে।
৪. কোথা থেকে কিনবেন
* বিশ্বস্ত উৎস: বিশ্বস্ত খামার বা পরিচিত, নির্ভরযোগ্য বাজার থেকে পশু কেনা সবচেয়ে ভালো। এতে পশুর স্বাস্থ্য রেকর্ড এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকে, যা আপনার ঝুঁকি কমায়।
* বিক্রেতার সততা: একজন সৎ বিক্রেতা আপনাকে পশুর বয়স, স্বাস্থ্য এবং কোনো ত্রুটি সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে বাধ্য।
* দিনের আলোতে কেনা: দিনের আলো থাকতে থাকতেই পশু কেনা উচিত। এতে পশুর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভালোভাবে যাচাই করা যায়। রাতের বেলা বা কম আলোতে পশুর ত্রুটিগুলো ভালোভাবে দেখা যায় না।
উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করলে আপনি ঈদুল আজহার জন্য একটি উপযুক্ত, সুস্থ এবং শরীয়তসম্মত পশু নির্বাচন করতে পারবেন বলে আশা করা যায়।
0 Comments