গাছ লাগানো
দারুণ শখের কাজ। কিন্তু সব গাছের চারা বীজ থেকে তৈরি করা সময়সাপেক্ষ এবং
কঠিন হতে পারে। আবার কিছু গাছ আছে যেগুলোর বীজ থেকে চারা করা প্রায় অসম্ভব।
তবে প্রকৃতিতে এমন অনেক উদ্ভিদ আছে যারা বীজ ছাড়াই বংশবৃদ্ধি করতে পারে!
এই পদ্ধতিকে অঙ্গজ জনন বলা হয়। এটি এমন এক প্রকার অযৌন জনন, যেখানে
উদ্ভিদের মূল, কাণ্ড, বা পাতার মতো কোনো অঙ্গ থেকে নতুন পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদ
তৈরি হয়। এই পদ্ধতিতে জন্মানো নতুন উদ্ভিদটি হুবহু মাতৃ-উদ্ভিদের মতো একই
গুণাগুণ সম্পন্ন হয়।
অঙ্গজ জননের প্রকারভেদ
অঙ্গজ জনন মূলত দুই প্রকার:
১. প্রাকৃতিক অঙ্গজ জনন
এই পদ্ধতি প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে, মানুষের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই। নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
মূলের মাধ্যমে: কিছু উদ্ভিদের মূল খাদ্য সঞ্চয় করে স্ফীত হয় বা মূলের গায়ে কুঁড়ি জন্মায়, যা থেকে নতুন চারা গজায়। যেমন: মিষ্টি আলু, পটল, সেগুন, ডালিয়া।
রূপান্তরিত কাণ্ডের মাধ্যমে: বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তিত মাটির নিচের কাণ্ড বা মাটির উপরে/উপ-বায়বীয় কাণ্ড দ্বারা বংশবিস্তার হয়।
টিউবার (Tuber) বা স্ফীত কন্দ: মাটির নিচের শাখার অগ্রভাগ খাদ্য সঞ্চয়ের ফলে স্ফীত হয়। এর 'চোখ' থেকে নতুন কুঁড়ি ও চারা বের হয়। আলু এর প্রধান উদাহরণ।
রাইজোম (Rhizome): এই কাণ্ড মাটির নিচে সমান্তরালভাবে বাড়ে এবং পর্বসন্ধি থেকে কাক্ষিক মুকুল ও শিকড় তৈরি করে। উদাহরণ: আদা, হলুদ, কলা।
বাল্ব (Bulb) বা কন্দ: এটি অতি ক্ষুদ্র কাণ্ড, যা স্ফীত ও রসালো শল্কপত্র (পাতা) দ্বারা আবৃত থাকে। কাক্ষিক বা শীর্ষ মুকুল থেকে নতুন চারা জন্মায়। উদাহরণ: পেঁয়াজ, রসুন।
স্টোলন (Stolon): এই কাণ্ড মাটির উপরে অনুভূমিকভাবে বাড়ে এবং পর্বসন্ধি থেকে নতুন উদ্ভিদ তৈরি করে। উদাহরণ: স্ট্রবেরি, কচু, পুদিনা।
অফসেট (Offset): জলজ উদ্ভিদের স্টোলনের মতো, যার প্রতিটি পর্বে পাতা ও শিকড়ের গোছা তৈরি হয় এবং পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন উদ্ভিদ জন্মায়। উদাহরণ: কচুরিপানা, টোপাপানা।
পাতার মাধ্যমে: কিছু উদ্ভিদের পাতার কিনারা বা প্রান্ত থেকে অস্থানিক মুকুল জন্মায়, যা বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়লে নতুন গাছ তৈরি হয়। উদাহরণ: পাথরকুচি (Bryophyllum), স্নেক প্ল্যান্ট (Sansevieria)।
২. কৃত্রিম অঙ্গজ জনন
কৃষি
ও উদ্যানবিদ্যায় মানুষের দ্বারা এই পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করা হয়, যার ফলে
দ্রুত ও উন্নত জাতের চারা তৈরি সম্ভব হয়। নিচে টেবিলের মাধ্যমে বিস্তারিত
তুলে ধরা হলো:
কৃষি ও উদ্যানবিদ্যায় মানুষের দ্বারা এই পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করা হয়, যার ফলে দ্রুত ও উন্নত জাতের চারা তৈরি সম্ভব হয়।
শাখা
কলম (Cutting): উদ্ভিদের কাণ্ড, পাতা বা মূলের অংশ কেটে উপযুক্ত পরিবেশে
রোপণ করা হয়। নতুন চারা তৈরি করতে প্রায়ই রুট-হরমোন ব্যবহার করা হয়।
উদাহরণ: গোলাপ, জবা, বেলি ফুল গাছ, রাবার গাছ।
জোড়
কলম (Grafting): উন্নত গুণাগুণের একটি উদ্ভিদের শাখা (সায়ন) নিন্মমানের বা
ভিন্ন কোনো উদ্ভিদের (স্টক) কাণ্ডের সাথে এমনভাবে যুক্ত করা হয়, যেন তারা
একসাথে বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ: আম, কমলা, লেবু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলের উন্নত জাতের চারা তৈরি।
দাবাকলম
বা গুটি কলম (Layering): কোনো গাছের শাখাকে মাতৃ-উদ্ভিদের সাথে যুক্ত থাকা
অবস্থাতেই মাটিতে বা আবৃত স্থানে মূল তৈরি করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। মূল
গজালে শাখাটি কেটে নতুন চারা হিসাবে রোপণ করা হয়।
উদাহরণ: লেবু, গোলাপ, জাম।
টিস্যু
কালচার (Tissue Culture): এটি আধুনিক ল্যাবরেটরি পদ্ধতি, যেখানে উদ্ভিদের
কোষ বা ছোট অংশকে কৃত্রিম মাধ্যমে বৃদ্ধি করে অসংখ্য নতুন চারা তৈরি করা
হয়।
উদাহরণ: অর্কিড, কলা, বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের চারা উৎপাদন।
বীজ ছাড়া বংশবিস্তারের সুবিধা
বীজবিহীন বংশবিস্তারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে:
দ্রুত ফলন: বীজ থেকে চারা তৈরি করার চেয়ে এই পদ্ধতিতে দ্রুত চারা তৈরি হয় এবং তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল পাওয়া যায়।মাতৃগুণাগুণ অক্ষুণ্ণ: নতুন উদ্ভিদ হুবহু মাতৃ-উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, ফলে উন্নত জাতের গুণাগুণ বজায় থাকে।
বীজহীন ফলের চারা: কলা, আনারসের মতো যে সকল উদ্ভিদে বীজ হয় না বা
হলেও তা নিষ্ক্রিয়, তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য এই পদ্ধতি অপরিহার্য।
কম সময়ে চারা উৎপাদন: বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অল্প সময়ে প্রচুর চারা উৎপাদন করা যায়।
ছাদে বা বারান্দায় চারা তৈরি
যাদের
ছাদে বা বারান্দায় টবে গাছ লাগানোর শখ তাদের জন্য এই অঙ্গজ জনন খুবই
উপযুক্ত একটি কৌশল। গাছের যে অংশ থেকে চারা উৎপাদন করতে চাই, যেমন: পাতা,
শাখা-প্রশাখা, শিকড়, মূল ইত্যাদি, সেই অংশগুলো দূর থেকে বহন করে আনলে
অবশ্যই সজীব রাখার চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ খেয়াল রাখতে হবে যেন শুকিয়ে না
যায়। সবচেয়ে ভালো হয়, ভেজা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নেওয়া। আবার পরিষ্কার পানিতে
ভিজিয়ে পলিথিনে করেও নেওয়া যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে গাছের সেই অংশই বেছে নিতে হবে, যেটিতে চোখ আছে। যেমন: ডালের গিঁটে চোখ থাকতে পারে। সেখান থেকেই কুঁড়ি বের হবে। ডাল, শাখা-প্রশাখা কাটার সময় ধারালো ছুরি দিয়ে তেড়চা করে কাটতে হবে। কাটার পরপরই পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় মাটিতে রোপণের আগে ছত্রাকনাশক দ্রবণে চুবিয়ে নেওয়া। এতে গজানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। মাটি অবশ্যই ঝুরঝুরে এবং যথেষ্ট আর্দ্র বা ভেজা থাকতে হবে। ডাল, শাখা বা শিকড় কাত করে রোপণ করতে হবে। আস্তে করে চারদিকে মাটি চেপে চেপে দিতে হবে। এরপর সামান্য পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় এরপর উপরে খড়, আবর্জনা বা ভেড়া চট দিয়ে ঢেকে রাখা। কুঁড়ি গজানোর পর চট সরিয়ে ফেলতে হবে।

0 Comments